ক্ষমতার আশ্রয়ে ধর্ষকেরা বেশি বেপরোয়া

 ক্ষমতার আশ্রয়ে ধর্ষকেরা বেশি বেপরোয়া


প্রথম আলো: নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একজন নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন এবং সেটার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আপনি এক কথায় কী বলবেন?

রুচিরা তাবাসসুম নভেদ: এমন ঘটনার ধাক্কাটা এত বেশি, প্রথমেই হতভম্ব লাগে। তারপর মনে হয়, সরকারের দায়িত্ব কিছু একটা করা। তারপর ভাবি, নাগরিকেরাই তো সরকারকে এনেছি। নিজেদের দায়িত্ব এড়ানোরও তো উপায় নেই। জেন্ডার আর স্বাস্থ্য আমার গবেষণার বিষয়। সবচেয়ে বেশি কাজ করছি নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে। কাজটার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছি। কিন্তু সব সময় একটা ভীষণ হতাশা থাকে।গবেষণা করে লাভটা কী হলো? আসলেই কি কিছু পাল্টাচ্ছে? কোনো কিছু কি হচ্ছে আদৌ? কী করছি আমরা!

দেশে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন আর যৌন সহিংসতার ঘটনা কি বাড়ছে?

রুচিরা: সত্যি বলতে কি, সে রকম কোনো ধারাবাহিক গবেষণা নেই। তাই এটা বলা যায় না। বললে সেটা হবে ধারণা থেকে বলা। ধারণা থেকে সিদ্ধান্ত টানা যায় না। ঘটনা বাড়ছে, নাকি ঘটনার জানাজানি বাড়ছে, তা নিয়ে বিভ্রান্তির সুযোগ আছে। সুতরাং আপাত তুলনা করলে ভুল হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১১ আর ২০১৫ সালে জরিপ করে বলেছিল, চার বছরে নারীর প্রতি সার্বিক সহিংসতার হার ৭৯ শতাংশ থেকে কমে ৭৩ শতাংশ হয়েছে। যৌন সহিংসতা ৩৭ শতাংশ থেকে কমে ২৭ শতাংশে নেমেছে।

তবে দুটি জরিপে পদ্ধতিগত পার্থক্য ছিল। পার্থক্যগুলো সমন্বয় করলে দেখা যাবে, ইতরবিশেষ হয়নি। বরং সহিংসতার কিছু ধরন সামান্য বেড়েছে। খুবই সামান্য।
বিবিএসের হিসাবটা কিন্তু স্বামীর হাতে সহিংসতার। এই সহিংসতাই সবচেয়ে বেশি ঘটে, ধর্ষণসহ। আমাদের এখনকার আলাপ অবশ্য বাইরের মানুষের হাতে যৌন সহিংসতা নিয়ে।

নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ধরন কিছু পাল্টেছে কি?

রুচিরা: পাল্টেছে তো বটেই। ইন্টারনেটের যুগে সাইবার বুলিং, ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করা—এগুলো অনেক বেড়েছে এখন। সেদিক থেকে আগের সঙ্গে তফাৎ আছে। কিন্তু যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ—এগুলো আগেও ছিল, এখনো আছে।
তবে জাতীয়ভাবে প্রচার হওয়া, সাড়া জাগা, এটা আগে এত ঘন ঘন হয়নি। ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাটা নিশ্চয় আগে বেশি ছিল। এখন আলাদা আইন আছে, মানুষজন জানে। প্রতিকার চায়। সাংবাদিকতার মনোযোগও বেড়েছে। ভেতরের খবর, প্রত্যন্ত এলাকার খবর আসছে। কিন্তু তারপরও মনে হয়, একটু যেন বেশি বেশি শুনছি।

বেগমগঞ্জের ঘটনা, সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের ঘটনাসহ গত দু-তিন বছরে যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলো কী প্রবণতার কথা বলে? বেপরোয়া ভাব? নৃশংসতা? নিষ্ঠুরতা?

রুচিরা: অপরাধীরা ক্রমেই আরও বেপরোয়া হচ্ছে। ক্ষমতায় যারা থাকে, তারা আরও বেপরোয়া। অন্য সহিংসতাও কিন্তু তীব্র হচ্ছে। এটা বৈশ্বিক প্রবণতা। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, পৃথিবীজুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলতার দাপাদাপি। মানুষ সুস্থ নয়।

অন্যদিকে আগেও কিন্তু ধর্ষণের ঘটনা খুব একটা কম নিষ্ঠুর ছিল না। আমার মনে হয়, পার্থক্যটা হচ্ছে প্রকাশ্যে এসব ঘটানোর বিষয়টা। এবং মানুষের নির্বিকার হয়ে পড়াটা।

আগে গ্রামে একটা সামাজিক যুক্ততা ছিল। এখন কিন্তু ক্ষমতাধর ব্যক্তির ছেলে যখন রাস্তায় মেয়েদের জ্বালাবে, গ্রামেও মানুষ না তাকিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। আগে সবাই মিলে হয়তো প্রতিরোধ করতে পারত। কিন্তু এখন ক্ষমতার ফারাকটা এত বেশি হয়েছে, সাধারণ লোক কিছু করতে সাহস পায় না।

এ জন্যই ওরা প্রকাশ্যে এসব অপরাধ করতে সাহসী হয়। ওরা জানে, ওদের থামানোর কেউ নেই। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। পুরুষত্বের ক্ষমতা প্রদর্শনও এটা—আমি কত কী পারি।

Post a Comment

أحدث أقدم